শস্যবধূ – কলাবউ

উমাশংকর নিয়োগী

শরৎকালে সপরিবারে দেবী দুর্গা তথা মহিষাসুরমর্দিনীর আরাধনা বাঙালির অন্যতম শ্রেষ্ঠ
উৎসব । নদী বিধৌত উর্বর ভূমি বাংলার অন্যতম প্রাকৃতিক সম্পদ, শস্যশ্যামল এর প্রকৃতি। বাংলার
মানুষ মূলত কৃষি নির্ভর। দুর্গা পূজাতেও তাই কৃষি এবং প্রকৃতি আরাধনার পরিচয় পাওয়া যায়।
আমাদের পূর্বপুরুষরা প্রকৃতি পূজার প্রচলন করেছিলেন মূলত অভাববোধ, কৃতজ্ঞতাবোধ এবং
ভয় থেকে। প্রকৃতি পূজা সূর্য, গাছ, নদী, পাহাড় ইত্যাদি কেন্দ্রিক হত। বর্তমানেও আমাদের মধ্যে
প্রকৃতি আরাধনা প্রচলিত আছে। কোন পূজা করতে গেলে ঘটস্থাপন করতে হয়, বেদিতে আলপনা,
তার উপর ধান দেওয়া হয়। ধানের উপর জলপূর্ণ ঘট, তাতে পঞ্চপল্লব বা আমের শাখা, ডাব
দেওয়া হয় । ঘটে সিঁদুর দেওয়া হয়। ঘটে পুতুল আঁকা হয়। সিঁদুর সূর্যের প্রতীক, পুতুল আত্মাশক্তির
প্রতীক। পাতা, ফল বৃক্ষের প্রতীক। পৃথিবীর সমস্ত সুপ্রাচীন জাতির মধ্যে কোন না কোন রূপে বৃক্ষ
পূজা প্রচলিত ছিল। এখনো তা আছেও ওক, আপেল, অশ্বত্থ, বিল্ব, নিম, তুলসী, গোলাপ, খেজুর
এই গাছগুলি অনেক জাতির কাছে পবিত্র ।
শাকম্ভবী দেবী দুর্গার আরাধনাও এককালে যে বৃক্ষে হত এর প্রমান আমাদের তন্ত্র এবং
পুরান, সাহিত্যে আছে। প্রকৃতির মধ্যেই সঞ্চিত আছে মানুষের বেঁচে থাকার সমস্ত রকম উপাদান।
জল, খাদ্যশস্য, ফল, রোগমুক্তির জন্য ভেষজ, আশ্রয়ের জন্য পর্বতের গুহা, বৃক্ষের কোটর, বিশ্রামের
জন্য গাছের শীতল ছায়া সবই। আমাদের অদি জাতি বৃদ্ধ প্রপিতামহগণ তাই প্রকৃতিকেই মাতৃজ্ঞানে
আরাধনা করেছেন। পণ্ডিতেরা বলেন মাতৃরূপে তথা দেবীভাবনার উৎস এই প্রকৃতি তথা পৃথিবী
পূজাই। ভারতের আধ্যাত্ম সাধনায় জড় ও চৈন্যের মধ্যে কোন ভেদ নেই। সবই ব্রহ্মা, চৈতন্যময়।
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে দেবীর চালচিত্রের মধ্যে বিশ্বপ্রকৃতিকে ধরার চেষ্টা হয়েছে। দেব-দেবী
আছেন, পশুপাখি আছে, সাপ আছে, আছেন মুনি ঋষি এবং গাছপালাও । দুর্গাপূজার একটি অন্যতম
অঙ্গ নবপত্রিকা। দেবীর ডান দিকে গনেশের অবস্থান। গনেশের ডান পাশে দিঘল ঘোমটা টেনে
দাঁড়িয়ে থাকে ‘কলাবউ।’ অনেকে কলাবউকে গনেশের স্ত্রী হিসাবে ভুল করে ফেলেন। কিন্তু নবপত্রিকা
তথা কলাবউ স্বয়ং দেবী দুর্গা। তন্ত্র মতে গনেশের নয়টি স্ত্রী। এরা হলেন— তীব্রা, জ্বালিনী, নন্দা,
সভোগদা, কামরূপিনী, উপ্রা, তেজবতী, সত্যা ও বিঘ্ননাশিনী। সম্ভবত ভ্রমবশত গনেশের এই নয়
পত্নীর বিষয় থেকেই নবপত্রিকাকে গনেশের স্ত্রী হিসাবে অনেকে মনে করেন। খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ
শতাব্দীর পূর্ব থেকে বাংলার দুর্গা পূজার সাথে নবপত্রিকা পূজার প্রচলন ছিল। মৈথিলী কোকিল
বিদ্যাপতি তাঁর দুর্গাভক্তিতরঙ্গিনী’ গ্রন্থের মধ্যে দুর্গাপূজার বিধান সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন, “ষষ্ঠার
বিল্বতরৌ বোধঃ সায়ংসন্ধ্যা সুকারয়েৎ/অথ সপ্তম্যাং পত্রিকা প্রবেশেন বিধিঃ।” স্মার্ত পণ্ডিত
রঘুনন্দন শিরোমনিও পত্রিকার উল্লেখ করেছেন। প্রথম বাংলায় রামায়ন অনুবাদক কবি কৃত্তিবাস ওঝা রামচন্দ্রের অকাল বোধনের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন, – “আচারেতে আরতি করিলা
অধিবাস।/ কান্দিলা পত্রিকা নব-বৃক্ষোর বিলাস।”
শারদীয়া দুর্গা পূজার শুভ সূচনা হয় বেল বরণ তথা বিশ্ব বৃক্ষের পূজোর মধ্য দিয়ে। ষষ্ঠীর
দিন সন্ধ্যায় বেল তলায় দেবীর বোধন হয়। এই বেল গাছকে দেবী দুর্গা রূপে কল্পনা করা হয়।
বোধনের দিন সন্ধ্যা বেলাতে নবপত্রিকা বেঁধে রাখা হয়। নবপত্রিকায় শাস্ত্রানুসারে এই গাছগুলি
থাকে- ‘বম্ভা কচ্চি হরিদ্রাচ জয়ন্তী বিশ্ব দাড়িম্বী। অশোক মান কশ্চৈব ধান্যশ্চ নবপত্রিকা।’ পাতাসহ
কলা চারা, কালোকচুর গাছ, মান কচুর গাছ, হলুদ গাছ, ধানগাছ, জয়ন্তী ডাল, অশোক ডাল,
ডালিম ডাল এবং বেল ডাল। এই বেল ডালে দুটি বেল থাকে। এই সবগুলিকে শ্বেত অপরাজিতার
লতা দিয়ে জড়িয়ে দেওয়া হয় এবং কলা খোলের মধ্য দিয়ে ভাল করে বেঁধে রাখা হয়। এই
নবপত্রিকাতেই কাপড় পরিয়ে ঘোমটা টানা বউ-এর রূপ দেওয়া হয়, একেই কলা বউ বলে।
সপ্তমীর সকালে বিধি অনুসারে নদী, দিঘি, পুকুরে স্নান করাতে নিয়ে যাওয়া হয়। বিশ্বশাখা
বা সিন্যৈ দুর্গায়ৈ নমঃ বলে পূজা করা হয়। নবপত্রিকার প্রতিটি গাছের এক একজন দেবী আছেন।
কলা গাছের দেবী ব্রহ্মানী, কচুর অধিধাত্রী দেবী কালিকা, হলুদের দুর্গা, জয়ন্তীর কার্ত্তিকী, বেলের
শিবা, ডালিমের রক্তদন্তিকা, অশোকের শোকরহিতা, মানকচুর দেবী চামুণ্ডা এবং ধানের দেবী
লক্ষ্মী রঘুনন্দন তাঁর ‘দুর্গাপূজা তত্ত্ব’ গ্রন্থে লিখেছেন, “ব্রাহ্মনী কদলী কাণ্ড দাড়িম্বে রক্তদন্তিকা।
ধান্যে লক্ষ্মী হরিদ্রায়াং দুর্গা মানক পত্রকে/চামুণ্ডা কালিকা কচ্চ্যাং দুনা শিবা বিশ্বে প্রতিষ্ঠিতা।
অশোকে শোকরহিতা জয়ত্যাং কাৰ্ত্তিকী স্মৃতা।।” কলা গাছের দেবী ব্রহ্মানীর কাছে সমগ্র বিশ্বের
শক্তি কামনাকরা হয়। বলা হয় রস্তারূপেন সর্বত্র শক্তি করু। কালিকার দয়া, দুর্গার কাছে সমস্ত
প্রকার বিঘ্ন নাশের প্রার্থনা, কার্তিকীর কাছে কাম্য বর পূরণের প্রার্থনা। শিবার কাছে কেবল আত্ম
সমর্পন এবং প্রনাম। রক্তদন্তিকার কাছে শত্রুনাশের বর প্রার্থনা, শোকবহির্তার কাছে শোকহীন
হওয়ার প্রার্থনা, চামুণ্ডার কাছে দয়া প্রার্থনা, লক্ষ্মীর কাছে সর্বদা বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য জোগানোর
প্রার্থনা জানানো হয়েছে।
নবপত্রিকার সবগুলিই দেবী দুর্গার এক একটি রূপের প্রতীক। নবপত্রিকা আসলে পৃথিবী
দেবীরই মূর্তি। শশিভূষন দাশগুপ্ত এই প্রসঙ্গে লিখেছেন- “বলা বাহুল্য এই সবই হইল পৌরানিক
দুর্গাদেবীর সহিত এই শস্য-দেবীকে সর্বাংশে মিলাইয়া লইবার একটা সচেতন চেষ্টা । এই শস্য
দেবী মাতা পৃথিবীর রূপ ভেদ। সুতরাং আমাদের জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে আমাদের দুর্গাপূজার ভিতরে
এখনও সেই আদিমাতা পৃথিবীর পূজা অনেকখানি মিলিয়া আছে।।” লতা, গুল্ম, শস্য, ঔষধি এবং
বৃক্ষকে পূজা কেন তা আমরা বিশ্ব উষ্ণায়নের তীব্রতায় মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছি।
একটা প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক এত লতা-গুল্ম-ঔষধি থাকতে নবপত্রিকার এই গাছগুলি কেন
স্থান পেল? এ সম্পর্কেও যৎসামান্য খোঁজ নেওয়া যেতে পারে।
১ কলা) কলা গাছের এমন কোন অংশ নেই যার ব্যবহার আয়ুর্বেদের উল্লেখ নেই। কলা।
গাছের শিকড় রক্ত বিকৃতিতে, কলা ডাঁটার রস কানের যন্ত্রনা নিবারনে, থোড়ের রস দিয়ে হিক্কা নিবারণে, পথ্য হিসাবে কাঁচা কলার ব্যবহার আয়ুর্বেদসম্মত। এছাড়া কাঁচা কলা, মোচা, থোড় এর
খাদ্যাস সর্বজন বিদিত। এর খোল, পাতার বহুল ব্যবহার হয়। পাকা কলা খাদ্য হিসাবে হাজারো
গুন সম্পন্ন। বাংলার জলবায়ুতে ভালোই কলা ফলে। তাই নবপত্রিকায় প্রথম স্থান কলা গাছের।
সহজে চাষ যোগ্য ও বহুগুন সম্পন্ন বলে নবপত্রিকায় প্রথমেই স্থান দেওয়া হয়েছে।
২. কচু) কচুর শাকে প্রচুর পরিমানে ভিটামিন এ, বি, সি, ক্যালসিয়াম, লোহা আছে।
রাতকানা রোগ প্রতিরোধে কচু শাকের অঙ্গ খাদ্য হিসাবে ব্যবহারের কথা সর্বজন বিদিত। কচুতে
প্রচুর পরিমানে আয়রণ আছে, প্রচুর ফাইবার, ফোলেট ও থায়ামিন যা আমাদের শরীরের জন্য
দরকারী। নিয়মিত কচু খেলে কোলন ক্যান্সার ও ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে কচুর
রোগ নিরাময়ে বলে প্রয়োগ ব্যবস্থা আছে।
৩ হলুদ) আমাদের যে কোন মাঙ্গলিক কাজে পূজা অৰ্চনায়, রান্নায়, রূপচর্চায় হলুদের বহুল
ব্যবহার সর্বজনবিদিত। ভারতে প্রাক বৈদিক যুগ থেকে হলুদের ব্যাপক উপকারিতা সম্পর্কে যে
মানুষ অবহিত ছিল তার প্রমান পাওয়া যায়। আয়ুর্বেদে আমাদের সমস্ত ব্যাধীর মূল কারণ হিসাবে
কফ, বায়ু ও পিত্ত বিকাশের কথা বলা আছে। হলুদকে ভিষগাচর্যরা এই তিনটি বিকারের ক্ষেত্রেই
প্রয়োগ করেছেন। আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য তাঁর ‘চিরঞ্জীব বনৌষধি’ গ্রন্থে লিখেছেন,—
“আমাতিসারে আমদোষের পাচনে, শীত পিত্তে (Urticaria) ক্রিমী, কুষ্ঠ, রক্ত পিত্ত, শোথ এবং
সর্বপ্রকার মেহ রোগে, এমনকি শুক্রদোষেও হরিদ্রার ব্যবহার।” আধুনিক গবেষনাগারে হলুদের
গুনাগুন নিয়ে প্রতিনিয়ত গবেষণা চলছে। নিত্য নতুন দিক উন্মেচিত হচ্ছে। এখন পর্যন্ত প্রায় ৬০০
রোগের ঔষধ হিসাবে হলুদ প্রয়োগ করা হচ্ছে। ১৪ টি মহৌষধী গুন আছে এর, ২০০৮ খ্রীষ্টাব্দে
‘ড্রাগস্ ইন আর অ্যাণ্ড ডি’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়, তার থেকে জানা
গিয়েছে হলুদে আছে ‘সারকিউমিন’ একটি বিশেষ উপাদান। সারকিউমিন কোলেস্টরল নিয়ন্ত্রণ
করে, ক্যান্সারের যন্ত্রনার উপশম ঘটায়, মানসিক অবসাদ দূর করে, রক্তের ঘনত্ব কমায়, ডায়াবেটিস
নিয়ন্ত্রণ করে। কেমোথেরাপীতে ব্যবহৃত অকস্যাল প্ল্যান্টিনের সঙ্গে সারকিউমিনের মিল আছে।
তাছাড়া দেহের যে কোন দাগ দূর করতে, অ্যান্টিসেপটিক হিসাবে প্রয়োগ করতে, রক্ত পরিস্কার
করতে, সর্বোপরি ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে হলুদে কার্যকারিতা সর্বজন স্বীকৃত।
৪ জয়ন্তী) জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রনে আয়ুর্বেদাচার্যগণ জয়ন্তী পাতার ব্যবহার করেছেন। ঋতুবতী
হলে সেই তিন দিন জয়ন্তী পাতা বেটে গুড় দিয়ে রোজ খালি পেটে বেশ কয়েক মাস খেলে
গর্ভধারনের ক্ষমতা চলে যায় অথবা শরীর খারাপ হয় না। শ্বেতী নিারাময়ে জয়ন্তী শিকড় ব্যবহার
হয়। বসন্ত রোগের প্রতিষেধক হিসাবে জয়ন্তী বীজ ব্যবহার হয়। এমন কি বোলতা, মৌমাছি ইত্যাদির
হলের যন্ত্রনা উপশম হয় জয়ন্তীর বীজে। মধুমেহ নিয়ন্ত্রণে শিশুদের সর্দিতে পাতার রস ব্যবহার হয় ।
এছাড়াও আরো বহুরোগের ক্ষেত্রে এই গাছের ফল, ফুল, পাতা ও শিকড়ের ব্যবহার হয়।
৫ বেল) বেল গাছের পাতা, ফুল, ফল, ছাল সবই ঔষধী হিসাবে ব্যবহার করা হয়।
বেলপাতার তিনটি পাতাকে নিয়েই একটি পাতা। মহাদেবের প্রিয় পাতা তিনটি ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের প্রতীক। আবার একে ত্রিনয়নের প্রতীক হিসাবেই ব্যবহার করা হয়। যজ্ঞে অতি দেবার
সময় বেলপাতার ব্যবহার হয়। প্রথমেই বলে রাখা যেতে পারে চরক পাকা বেলের অধিক ব্যবহার
নিষিদ্ধ করে গিয়েছেন। পাকা বেল অস্ত্রে ছিদ্র করে দিতে পারে। কাঁচা বেল সবথেকে বেশি
উপকারী। আমাদের একটি ভ্রান্ত ভারনা আছে পাকা বেল পুরানো মল পরিস্কারক। এটি সর্বৈর
সত্য নয়। নিজে মল হয় মল পরিস্কারের ক্ষমতা নেই। বেলে প্রচুর পরিমানে ভিটামিন বি কমপ্লেক্স,
শ্বেতসার, ক্যারোটিন, ক্যালসিয়াম এবং আয়রণ আছে। বেল পুরানো আমাশয় দোষ নষ্ট করে,
কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। অবশ্য কাঁচা বেল, কারণ পাকা বেল ‘পক্ক বিল্বং বিষোপমম আমং ত্বং
অমৃতোপরম্’ অর্থাৎ পাকা বেল বিষের মতো শরীরের ক্ষতি করে আর কাঁচা বেল অমৃতের মত
উপকারী। সুগার রোগ নিরাময়ে, গায়ের দুর্গন্ধ দূর করতে, যৌবনের উদ্দীপনা রোধে তথা কাম
নিয়ন্ত্রনে, হাত পা ফুলাতে অব্যাহতি পেতে বেল পাতার রস বিভিন্নভাবে প্রয়োগ করেন।
আয়ুর্বেদাচার্যগণ অস্ত্রের ঘা সারাতে, কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে বেলের গুঁড়ো ব্যবহার হয়। অর্শরোগ
নিরাময়ে, হার্টের দুর্বলতা দূর করতে বেল গাছের বিভিন্ন অংশ প্রয়োগ করা হয়।
৬ দাড়িম) দাড়িম তথা ডালিমকে আমরা জেনে না জেনে এর বহুল ব্যবহার করি। মূলত
রোগীর পথ্য হিসাবেই ডালিম বা বেদানা ব্যবহার হয়। কিন্তু ডালিমের হাজারো ভেষজ গুন।
ডালিমে বিউটেলিক অ্যাসিড, আরসোলেকি অ্যাসিড এবং কিছু অ্যালকালীয় দ্রব্য যেমন
সিডোপেরেন্টইবিন, পেপরেটাইবিন ইত্যাদি আছে। হার্ট ভালো রাখতে বেদানা বা ডালিমের
জুড়ি নেই। কোলেস্টরল কমাতে, হার্টের পেশিতে দ্রুত অক্সিজেন পৌঁছে দিতে সাহায্য করে,
বেদানার রস ত্বক সুস্থ্য রাখতে উপকার করে। এই ফলে ফলিক অ্যাসিড, ভিটামিন সি, সাইট্রিক
অ্যাসিড প্রচুর পরিমানে আছে, যা ত্বক ক্যান্সার রোগের প্রতিরোধক হিসাবে কাজ করে। কেবল
স্কিন ক্যান্সার নয় প্রোস্টেট ক্যানসার প্রতিরোধিত বেদনার রস। রক্তাল্পতা সারাতে বেদনার জুড়ি
মেলা ভার ৷ জন্ডিস, বুক ধড়ফড়ানি, কাশি, পুরানো পেটের অসুখ এবং জ্বর সারানোতে বেদানার
রসের কার্যকর ভূমিকা লক্ষ্য করেছেন গবেষকেরা। বাত প্রতিরোধে, ক্ষমতা বৃদ্ধিতে ডালিমের
বহুল ব্যবহার প্রচলিত। এছাড়াও বহু রোগ উপশমে ও প্রতিরোধের উপায় হিসাবে ডালিমের ছাল,
শিকড়, ফুল ইত্যাদির প্রয়োগ হচ্ছে। ডালিম ফলের গুন দেখে আমাদের বিষ্ময়ে স্তব্ধ হয়ে যেতে
হয়।
৭ অশোক) মূলত অশোক গাছের ছাল এবং ফুল ঔষধী হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এই গাছের
ছালে প্রচুর পরিমানে ট্যানিন, হিমাটক্সইলিন, খনিজ দ্রব্য এবং স্যাবানিয়াম আছে। বায়ু বিকার
জনিত নানা রোগে বৈদ্যকুল অশোক ছালের প্রয়োগ করেন। সায়াটিকা, স্নায়ুগত বাতে অশোকের
মত উপকারী ভেষজ গুনসম্পন্ন গাছ আর নেই। অধিক সন্তান প্রসবের জন্য বা অন্য কারনে
জয়ায়ুর স্থানচ্যুতি ঘটলে, শ্রেত প্রদবে বা রক্ত প্রদরে মৃত বাৎসা রোগে অশোক গাছের ছাল
ব্যবহার হয় । অশোক গাছের বহুল ব্যবহার স্ত্রীরোগ বিষয়েই। এছাড়াও হার্টের দুর্বলতায়, চামড়ার
কর্কশতায়, প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। জানিনা কারন এই সব কারনেই অশোক কাননেন সৃষ্টি করেছিল কিনা ?
৮ মান) মান কচুর গুনে মুগ্ধ হয়ে প্রার্থনা মন্ত্রে বলা হয়ে সুর এবং অসুর দুজনেরই মান
দায়িনী মান কচু। মান কচুতে আছে ম্যাগনেশিয়াম, আয়রন, ফাইবার, পটাশিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ এর
মত দরকারী পুষ্টি উপাদান । এতে প্রচুর পরিমান অ্যান্টি অক্সিডেন্ট আছে। বিটাক্যাটারিন যা শরীরে
রোগ সৃষ্টিকারী র‍্যাডিকেলসকে দূরে রাখে। শরীরে আয়রনের ঘাটতি পূরণে ও দৃষ্টিশক্তি বাড়াতে
মানকচু কার্যকর। সহজ পাচ্য মানকচু সর্দিকাশি দূর করে, মাথাব্যথা কমায়। এমনকি ভাইরাস
ঘটিত রোগেও মানকচুর প্রয়োগ করেন বৈদ্যরা। হার্টবিট নিয়ন্ত্রণে রাখতে মানকচুর ব্যবহার হয়।
৯ ধান) পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রধান খাদ্য ধান থেকে উৎপন্ন হয়। ঐতিহাসিক
ভাবে প্রমান পাওয়া যায় চিন এবং জাপানে দশ হাজার বছর আগেও ধান চাষ হয়েছে। আমাদের
দেশের প্রধান খাদ্য ভাত। যা ধান থেকেই পাওয়া যায়। এছাড়া বাংলা তে প্রধান অর্থকরী ফসল
হল ধান ৷ ধান আমাদের জীবনের প্রতীক প্রান দায়িনী। ধানগাছের শস্য থেকে গাছ সবকিছুই কোন
না কোন ভাবে আমাদের কাজে লাগে। যে কোন পূজাতে মাঙ্গলিক কর্মে ধানের ব্যবহার হয়। ধান
থেকে চাল, তার থেকে ভাত এর খাদ্যগুন সম্পর্কে আলোচনা বাহুল্য মাত্র হবে। তবুও সংক্ষেপে
বলা যায় ভাত বলকারক, বায়ুনাশক এবং লঘুপাচ্য। চালকে বিভিন্ন ভাবে ব্যবহার করেন বৈদ্যরা।
বিশেষত অগ্নিবল বৃদ্ধিতে, অরুচিতে, বাতরোগ, মূত্রকৃচ্ছতায়, অপুষ্টিজনিত দুর্বলতায়, বহুমূত্র
রোগে চালের মণ্ড নানাভাবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
অপরাজিতা ঃ নবপত্রিকা বাঁধা হয় শ্বেত অপরাজিতার লতা দিয়ে। জেনে নেওয়া যেতে
পারে এত লতা থাকলেও আমাদের পূর্বপুরুষ তথা শাস্ত্রকারেরা কেন অপরাজিতা কে নির্বাচন
করেছেন।
অপরাজিতা বাহ্য বা আভ্যন্তর প্রয়োগ করে বহু রোগ নিরাময়ের হদিস দিয়েছেন বৈদ্যকুল।
বিশেষত হিষ্টিরিয়া বা এপিলেপসি প্রতিরোধে শ্বেত অপরাজিতার মূল, পাতা এবং গাছ থেঁতো
করে খাওয়ানোর ব্যবস্থা আছে। বিশেষ করে মেয়েদের হিষ্টিরিয়া তথা ভূতোন্মাদ রোগ সারানোতে
এই গাছের জুড়ি নেই। বৈদ্যরা থাইরয়েড গ্ল্যাণ্ডের চিকিৎসাতেও এই গাছের শেকড় ব্যবহার
করেন। মেধা বৃদ্ধিতে ব্রাহ্মী পাতার মত অপরাজিতা লতারও ব্যবহার হয়। বহুমূত্র রোগে, গলক্ষতে,
আধকপালে, খোস-পাঁচড়া নিরাময়ে এই লতার শিকড় ও পাতার রস প্রয়োগ করা হয়। অন্যান্য
লতার তুলনায় অপরাজিতার রোগ নিরাময় ও প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি। নবপত্রিকাকে এই লতা
দিয়ে বাঁধা হয়।
আমাদের পূজা অর্চনাতে পঞ্চপল্লব, পঞ্চগব্য, পঞ্চামৃত, পঞ্চশস্য, পঞ্চগুঁড়ি ইত্যাদি পঞ্চের
ছড়াছড়ি। দুর্গপূজাতে হঠাৎ করে নবপত্রিকা কেন। একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে দুর্গাপূজাতে নয়
সংখ্যার আধিক্য। অষ্টমীর দিন দেবীর নবশক্তির কল্পনা করা হয়েছে। এই নবশক্তি হলেন উগ্রচণ্ডা,
প্রচণ্ডা, চণ্ডোগ্রা, চণ্ডনায়িকা, চণ্ডা, চণ্ডাবতী, চণ্ডরূপা, অতিচণ্ডীকা ও রুদ্রচণ্ডী ৷ এছাড়া চণ্ডীকেও
দেবীর নটি রূপের কল্পনা করা হয়েছে। নবরাত্র পালনের সময় এই নবদেবীর পূজা হয়,
প্রতিপদের দেবী শৈলপুত্রী, দ্বিতীয়ার ব্রহ্মাচারিনী, তৃতীয়ায় চণ্ডকন্টা, চতুর্থীর কুষ্মাণ্ডা, পঞ্চমীর দেবী স্কন্দমাতা,
ষষ্ঠীর কাত্যায়নী, সপ্তমীর কালরাত্রী, অষ্টমী তিথির দেবী মহাগৌরী এবং নবমী তিথির দেবী
সিদ্ধিদাত্রী। স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘মহিষাসুরমদ্দিনী-দুর্গা’ গ্রন্থে দেবী দুর্গার নব রূপ
সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন, ‘দেবী দুর্গার আবত্ত নটি মহিমোজ্জ্বল রূপের উল্লেখ ও বর্ণণা
আছে। যেমন প্রেতাসীনা, চামুণ্ডা, মহিষাসীনা বারাহী, গজাসীনা ঐন্দ্রী, গরুড়াসীনা বৈষ্ণবী, নারসিংহী,
শিবদূতী, বৃষসীনা মাহেশ্বরী, শিখিবাহনা কৌমারী, হংসাসনা ব্রাহ্মী ও পদ্মাসীনা সৌভাগ্যদারিণী
লক্ষ্মী। এছাড়াও আরও দেবীর নটি রূপের পরিচয় পাওয়া যায়- চতুর্মুখী হংস বাহনা সৃষ্টির পা
জগদ্ধাত্রী, বৃষবাহনা সৃষ্টি সংহারকারিণী মাহেশ্বরী, ময়ূর বাহনা শক্তিহস্তা কৌমারী, শঙ্খচক্রগদাপদ্ম
ধারিনী গড়ুর বাহনা দেবী বৈষ্ণবী, বারাহী, দৈত্যদানব নাশিনী নারসিংহী, সহস্রনয়না ইন্দ্রানী, মুণ্ডমালা
বিভূষিতা চামুণ্ডা এবং দশভূজা মহিষাসুরমর্দিনী দেবী কাত্যায়নী। এতগুলি নবরূপের জন্যই এর
সাথে সাথে মিল রেখে দেবী শাকান্তরী নবপত্রিকারূপা দেবী দুর্গার ঐ বৃক্ষা ভেবজ শস্যকে নটি
নেওয়া হয়েছে।
কথায় আছে নানা মুনির নানা মত, কিন্তু নবপত্রিকা বিষয়ে পণ্ডিতেরা এক মতে পৌঁছাতে
পেরেছেন। তা এক বাক্যে সকলেই বলেছেন নবপত্রিকা আসলে শস্য দেবী। শশিভূষন দাসগুপ্ত
লিখেছেন, “এই শস্যবধূকেই দেবীর প্রতীক বলিয়া গ্রহণ করিয়া প্রথমে পূজা করিতে হয়। তাহার
কারন শারদীয়া পূজা মূলে বোধহয় এই শস্যদেবরই।”

Facebook
WhatsApp
Email
Scroll to Top