সহজ পাঠে আমার রবীন্দ্রনাথ

নিরঞ্জন জানা

বনে যে বাঘ থাকে, গাছে যে পাখি, জলে যে মাছ থাকে ,ডালে যে কাক ডাকে, খালে যে বক মাছ ধরে, মৌচাকে যে মৌ-মাছি থাকে তাদেরকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “তোমরা আমার রবি ঠাকুরকে দেখেছো ?” তারা বলল, “আলো ভরে এলে চারদিক যে ঝিকমিক করে, দিঘিজল ঝলমল্ করে ওখানেই রবি ঠাকুর আছে।”
কয়েক পা এগিয়ে, বনময় যে বায়ু বয়, হাওয়ায় যে বাঁশ গাছ নাচে, যে ঝাউডাল তাল দেয়– ওদের জিজ্ঞেস করলাম-“এই পথে রবি ঠাকুরকে দেখেছো?” ঘাড় নেড়ে বলল , “একটু এগিয়ে দেখ।”
জাম পাড়ে যে খুদিরাম, খেয়া বায় যে মধু রায়…হাল ধরা জয়লাল, ঘাস কাটা অবিনাশ , ঘর বাঁধা হরিহর,রাঁধুনি দীননাথ,
চাষা গুরুদাস বলল, ” ওহে খোকা ! নিশ্চয় রবীন্দ্রনাথকে খুঁজছ?– আমাদের কর্ম বা কাজ-ই হল রবীন্দ্রনাথ।”
যে রাম বনে ফুলে পাড়ে,ফুল তুলে সাজি ভরে বাড়ি চলে , যে ভোলা মালী মালা নিয়ে ছোটে ,তাকে বললাম- ” কে রবীন্দ্রনাথ ?” তারা বলল, “পূজার ফুল ও মালা হল রবীন্দ্রনাথ।” যে ছোটো খোকা দোলা চ’ড়ে দোলে– সে এবং “পুব দিকে ঘুম-ভাঙা” রাঙা চোখের উষা বলল–“আমাদের হাসি-ই তো রবীন্দ্রনাথ।” ভয়ের পথে যে চাঁদ সাথে সাথে যায়, যে তারাগুলি সারারাত বাতি জ্বালিয়ে জাগে, তারা বলল-” আঁধারে যে আলো ফোটে তা-ই রবীন্দ্রনাথ।”।
যে বায়ু দিকে দিকে ফেরে সবাইকে ডেকে ডেকে , যে পাখি বনে বনে জাগে, মেঘে মেঘে যে রঙ লাগে, জলে জলে যে ঢেউ ওঠে , ডালে ডালে যে ফুল ফোটে তাতেই রবি ঠাকুরের প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে।
যে ‘আশাদাদা আজ ঢাকা থেকে এল’,, যে ‘আশাদাদা আর তার ভাই কালা কাল ঢাকা ফিরে যাবে’ ,তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “আশাদা,রবীন্দ্রনাথ কি পুব বাংলায়-ও আছে?” সে একটু হাসল। তারপর বলল, “আতিথেয়তা আর আত্মীয়তা যেখানে সেখানেই রবীন্দ্রনাথ।”
আশ্চর্য হয়ে মোতিঝিলের দিকে গেলাম। সেখানে যে হাঁসেরা ভেসে ভেসে কোলাহল করে , যে বক পাঁকের দিকে চেয়ে থাকে , যে চিল উড়ে চলে, যে মাছরাঙা ঝুপ্ করে জলে পড়ে সেখানেও দেখি রবীন্দ্রনাথ ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আরও আশ্চর্য হয়ে গেলাম– বেলা শেষে সারিগান গেয়ে ডিঙি চড়ে গাঁয়ে ফেরা চাষির দলে, মোষ নিয়ে পার হওয়া রাখালছেলের মাঝে , বাঁশে বাঁধা জাল নিয়ে মাছ ধরা জেলেদের মধ্যে ,জলে ভাসা শ্যাওলার ভিড়েও দেখি রবীন্দ্রনাথ। একটু দূরে যেই গিয়েছি দেখি বিনিপিসি, বামি, নীলু ও রাণীদিদির সাথে ছোট্ট রবি খেলে বেড়াচ্ছে!
পায়ে বেড়ি দেওয়া টিয়াকে যে রাণীদিদি দানা দেয়,যে বুড়ি দাসী জল দেয়, যে ‘দীনু এই পাখি পোষে’ তারাও স্বীকার করেছে — খোলা আকাশে উড়ে বেড়ানো, মুক্তির স্বাদ-ই রবীন্দ্রনাথ।
যে হরি মুদি পথের ধারে দোকানে বসে চাল- ডাল, তেল নুন-বেচে ,যে বুড়ি ঢেঁকিতে ধান ভানে ,খোলায় খই ভাজে ,যে বিধু গয়লানী দুধ দোয় সেখানেও দেখেছি রবীন্দ্রনাথকে । যেখানে কানাই – বলাই জড়ো করে সরিষা কলাই, যে বড়ো বউ মেজো বউ পাঁচিলে ঘুঁটে দেয় সেখানে ভায়েদের ভাতৃত্ব আর বউদের সখ্যতায় রবীন্দ্রনাথ।
যে ‘দুখী বুড়ি উনুন-ধারে উবু হয়ে ব’সে
আগুন পোহায় আর গুন্ গুন্ গান গায়’–“শেষ বেলাকার শেষের গানে /ভোরের বেলার বেদন আনে।”–সেই গান-ই তো রবীন্দ্রনাথ। ছুটির দিন কুলবনে গুপী ও নুটু’র সাথে রবি ঠাকুরকে দেখতে পাই। কুলের অম্ল-মধুর স্বাদে উমা ও উষা’র মুখে হাসি -খুশি ভাবে রবি ঠাকুর। যে ‘চুনী মালী কুয়ো থেকে জল তোলে ‘ সে বলে, ‘ এই ঠাণ্ডা জল-ই রবীন্দ্রনাথ। ‘
বৈশাখে হাঁটু জল থাকা আমাদের ছোটো নদীর পাড়ে,ফুলে ফুলে সাদা কাশবনে ,কিচিরমিচির করা শালিখের ঝাঁকে, আমবন তালবনের ছায়ায় ঢাকা বামুনপাড়ায় রবি ঠাকুরকে খুঁজে পাই। গামছায় জল ভরে ছেলে-মেয়ের গায়ে ঢালার মজা,আঁচলে ছেঁকে ছোট মাছ ধরা ও বাসন মেজে ,কাপড় কেচে ঘরে ফেরা বধূদের কথা যিনি লেখেন তিনি-ই রবীন্দ্রনাথ।
শরৎ-এর হিমহিমানির পরশলাগা হাওয়ায়, সকালবেলার ঘাসের ডগায় জমা শিশির রেখায় , আমলকী বনে খসা পাতায়, শিউলির ডালে কুঁড়িতে , মালতী লতার খোঁজ নিয়ে যাওয়া মৌমাছির ডানায় রবি ঠাকুরের মুখ। শৈল, কৈলাশ, মৈনিমাসি, বেণী বৈরাগী, লোকা ধোবা ,গৌর, কৌলু, সৌরিদিদি সবার সাথে রবি ঠাকুর। ক্ষ্যাপা বৈশাখে কিংবা কালবৈশাখীতে, যে “নির্ঝরের স্বপ্ন ভঙ্গ” হয় সেখানেও— রবীন্দ্রনাথ।
“যেমনি এ কথা বলা অমনি হঠাৎ
কড্ কড়্ রবে বাজ , মেলে দিল দাঁত।
ভয়ে কাঁপি, মা কোথাও নেই কাছাকাছি
ঘুম ভেঙে চেয়ে দেখি বিছানায় আছি।”
ঘুম ভেঙে দেখি–
বুকের ওপর পড়ে আছে ‘সহজ পাঠ’।
সেই সহজ পাঠের সহজ কথা
আমার রবীন্দ্রনাথ।
—— ——‐ ——

Facebook
WhatsApp
Email
Scroll to Top