দুর্গা : মহানায়িকার মাহাত্ম্যে

আশিষ করণ

গোবিন্দনগর

যদি তারে নাই চিনি
শব্দটি উচ্চাণের সাথে অনিবার্যভাবে ভেসে ওঠে একটি ছবি। অবশ্যই তা
কবেকার শৈশবও সে দৃশ্যের সাক্ষী। পায়ের নীচে রক্তাত মহিষাসুর, দশাকে দশ আসুন,
তিন ভুবনের তেজ— এরকম এক নারী মূর্তির কাছে আমরা শাশ্বত আনত।
“ওঁ সিং হস্তা শশিশেখরামরকতপ্রধ্যৈ চতুর্ভিজি
শঙ্খং চক্রধনুঃশয়াংশ্চ দধতী নেত্রৈত্রিভিঃ শোভিতা।
আমুক্তাঙ্গদহারকঙ্কনরণৎ কাঞ্চীরণদ্মপুরা
দুর্গাদুর্গতিহারিণী ভবতু নো রত্নোল্পসংকুগুলা।।”
তিনি দেবী না হলেও ক্ষতি ছিল না তেমন। শক্তিতে সবাই বর্ণীভূত। পুজো
তাঁর চরণে। পিছনে পিছনে সংস্কার। অল্পবিস্তর বাহুল্য। আর বদি তা হয় অশুভের এবং শুভের
উত্থানে মূর্ত, তবে তো কথা নেই। জগতের মঙ্গলার্থে সুচিন্তিত সৃষ্টি ত্রাতার ভূমিকার নেমে আসা
মর্ত্যলোকে, বিশ্বাসের এই জমিতে মাথা তোলা আরাধনার সহস্র বৃক্ষ। এমনকী আচরণে অভ্যাে
যিনি এর বিপরীতে, ধূপ ধুনো বৈদিক মূর্ছনাকে তিনিও অস্বীকার করতে পারেন না কিছুতেই।
মণ্ডপে মন্দিরে তাঁর অনায়াস বাতায়াত। আগুন শুধু চোখে নয়, সৌন্দর্যেও। মায়ানর রূপেও আমরা
সম্মোহিত। মন্ত্র না জেনেও মন্ত্রমুগ্ধ। সুতরাং যেখানে শক্তি ও সৌন্দর্যের মিলন, মানুষের সামা
তা তীর্থভূমি। একান্ন পীঠের এক পীঠ।
অথচ তীব্র ব্যবধান। অবিলতায় সমূহ অনুসরণ। প্রাপ্তির কাছাকাছি গিয়েও অপ্রাপ্তিতে
আক্রান্ত সাধারণ। কাজেই তিনি কখনও মাটির প্রতিমার অতিরিক্ত হারে ওঠেননি। এ ব্যর্থতা আমাদের।
দ্রুততা আসাম্য দায়ভারে বিচ্যুত ধ্যান। সামান্য আহতিরে অধরা অসামান্য। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন,
“ভেবেছিনু মনে মনে দূরে দূরে থাকি/চিরজন্ম সংগোপনে পূজিব একাকী…। ভক্ত ও ভগবানের
দুর্নিবার দূরত্ব। উৎকণ্ঠা তাই ধর্মের আশ্রয়। কেউ কেউ বুঝি এর ব্যাতিক্রম। তাঁরা দেবের
অংশবাদৃতজ্ঞানে মান্য। অন্যেরা দুস্তর পারাবারে। সাঁতার শিখতে শিখতে দুর্লভ আবুর সমাপ্তি।
কিন্তু যে মেয়েটি নদীতে স্নান সেরে বাড়ি ফিরেছি আর স্থানে স্থানে ছড়াচ্ছে নিজতার
বৈভব— দেশের স্বাধীনতায় যাঁদের ঘোষণা এমনই দীপ্ত, “জীবন মৃত্যু পারের ভৃত্য, চিত্ত ভাবনাহীন….
—সংসার নামক তপ্ত খেলায় যে গৃহবধূ অস্তিত্ব সংগ্রামে প্রত্যহ অটুট— বাবতীর। শোক সর্বনাশ
উপেক্ষা করে যিনি সন্তানস্নেহে বুকে ধরেন ভিখিরী শিশু, তাঁরাই প্রকৃত দুর্গা, রক্তমাংসের দেবী।
সজীব ও সাহসিনী। দেবালয়ের চার দেয়াল তাঁদের মগ্নতার চূর্ণ। মনীন্দ্র গুপ্তের মতে, “যে আমাকে
দু-বেলা খেতে দেবে/সে আমার কাছে মা দুর্গা।” দুঃখ এটাই, এঁরা যথারীতি অবহেলিত। কোনও
নৈবেদ্য এদের জন্য নির্দিষ্ট নয়। যদিও এঁরাই বেশি আপনজন। মারের মতো সুন্দর। অন্তরের সবটুকু । শ্রদ্ধা যতদিন না উজাড় করছি এইসব জীবন্ত দুর্গার অন্তরে ততদিন মানবিকতার বিচারে পিছিয়ে
পড়ছি। এটা পুরুষতান্ত্রিকতার কলঙ্ক। আসলে উভয় দিকেই আমরা অন্যমনষ্ক এবং অঞ্জলি শেষমেশ
বাতাসের অধিকারে।
কবে আমি বাহির হলেম
পৃথিবীতে তো বটেই, এই রাজ্যেও এমন অংসখ্য মহিয়সীর পদার্পন ঘটেছে যে, বাঙালির
নিজস্ব সংস্কৃতিতে সম্পৃক্ত। প্রতিভার অভূতপূর্ব স্বাক্ষরে তাঁরা ঈশ্বরীর মতোই সামর্থ্য ও সমৃদ্ধির
আধার। কুমতির বিনাশক এবং সুমতির প্রতিষ্ঠাতা। হয়তো প্রত্যেকে ‘রণং দেহি’ নন। প্রকট ও নন
কাঙ্খিত প্রত্যাশায় বা আবাহনের প্রাচুর্যে। যুদ্ধ কেবল বাইরে নয়, ভেতরেও এবং এই লড়াইয়ে
জয়ীরাই আসল যোদ্ধা। ‘সকল রসের ধারা’ এঁদের উপরে বর্ধিত। বিশেষ করে, সেসব নামের সাথে
যখন জড়ায় পশ্চিমবঙ্গের নাম। দিয়াগো মারাদোনা বা নেলসন মেন্ডেলার সঙ্গে যেমন একটি ভূখণ্ড
জড়িত। আর বাংলার রবিঠাকুর। পুরুষের পাশাপাশি নারীদের তালিকাও দীর্ঘ। উদাহরণের একপেশ্রেণীর
পরিবর্তে উদ্ধৃতি এখন আমার পাথেয়। বর্তমান রচয়িতা লিখিত ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এ (১৮ এপ্রিল
২০০৭) প্রকাশিত একটি চিঠি-
“কী অসীম অন্তরালে অতিক্রম করে এলেন জীবনের আটাত্তরটি বসন্ত। কী নিষ্ঠুর নির্বাসনে
নিজেকে আবৃত করে রাখলেন সংযম আর সাধনার ঘেরাটোপে। উৎসবে বিপুল আয়োজনে
আলোক উজ্জ্বল মঞ্চে সম্মানিতভাবে ধরে এনে কৃতজ্ঞতা-অভিনন্দন-শুভেচ্ছাসহ আপনার হাতে
আপনারই প্রিয় রজনীগন্ধা উপহার দেওয়ার সুযোগই দিলেন না আমাদের। দূরে দাঁড়িয়ে আমরা শুধু
আমাদের প্রণাম-মুগ্ধতা-বিস্ময় প্রকাশ করতে পারি। ছবি ছেড়ে দেওয়ার পর কোথাও কোনও অনুষ্ঠানের
ফিতে কাটলেন না, মাইক্রোফোনের সামনে মুখ রেখে দারুন বক্তৃতা দিয়ে ভুল করেও কাউকে
চমকে দিলেন না, প্রধান অতিথির জন্য নির্দিষ্ট আসনটিতে একবারের জন্যও বসলেন না— এমনকী,
‘দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার’ গ্রহণ করতেও স্বরচিত বৃত্তের বাইরে বেরোলেন না। শুধু মহানারিকা
হিসাবে নয়, সেলিব্রিটির ইশারাময় আলো এড়িয়ে একজন স্বনির্বাসিতা নারী হিসাবেও আপনি
প্রণম্য হয়ে রইবেন আপামর বাঙালি হৃদয়ে। এই বিশ্বাস আমার মতো অনেকেরই আছে। এই
প্রত্যাখ্যান মানুষকে মনে রাখতেই হবে। এই আসক্তিহীনতার তীব্র আগুন পুড়িয়ে আমাদের খাঁটি
সোনা করে যাবে। কাজেই আপনি শুধু সুচিত্রা যেন কেউ আপনাকে ‘সুচিত্রাদি’ বলে ডাকবার
মতো অন্তরঙ্গতাই পেল না কখনও। মাঝে মাঝে মনে হয়, ‘এই করেছ ভাল নিঠুর, এই করেছ ভাল… ”
যাঁকে হাত দিয়ে ধরা যায় তাঁর কাছে হৃদয়ের সঙ্গে নতজানু হওয়ার আবেগটাই যায় মরে। “আলো
আমার আলো’, ‘সপ্তপদী’, ‘পথে হল দেবী’, ‘অগ্নিপরীক্ষা’, ‘সাত পাকে বাঁধা’র আবেশ কাটতে না
কাটাতেই যখন হঠাৎই শুনে ফেলি দীপ জ্বেলে যাই’ ছবির শেষ দৃশ্যে হাসতে হাসতে আর কাঁদতে
কাঁদতে পাগলিনীপ্রায় আপনি ঘোষনা করেছেন, “আমি একবারও অভিনয় করিনি… আমি অভিনয়
করতে জানি না…” সেই মুহুর্তে আমরা আমূল কেঁদে উঠি। আপনার উচ্চারণ প্রবল সত্য হারে যার
আমাদের কাছে। আপনি অভিনয় করতে করতে জানেন না। ছবির পর ছবিতে শুধুমাত্র অভিনয় করে গেলে অভিনয় ছেড়ে দেওয়ার এত বছর পরেও আপনাকে এত স্মরণীয়-বরণীয়-পূজনীয় করে।
রাখবার কোনও প্রয়োজন হতো না আমাদের। আপনি অভিনয়কে শিল্প করে তুলেছেন। এই কারণেই
আপনার প্রয়োজনীয়তা আমাদের কাছে কখনই ফুরোবে না। আমাদের প্রেম-পরশ্রীকাতরতা-আঘাত
–আনন্দ-পাপ-পরাজয় আপনার অনুকরণীয় শিল্পীসত্তার সঙ্গে একাকার হয়ে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনও
পথ খুঁজে পাবে না। এই ভবিতব্যের কাছে চিরকাল ফিরে ফিরে আসতেই হবে আমাদের। আপাতত
প্রার্থনা করি আপনার বয়স হোক হাজার কোটি…….”
হ্যাঁ, তিনি সুচিত্রা সেন। বিশ্বের সমস্ত বাংলাভাষীর বৈপ্লবিক অভিজ্ঞান । আমার দুর্গা । কোনও
স্বর্গীয় ব্যাকরণ তাঁর মধ্যে নেই। মাতঙ্গিনী হাজরার দুঃসাহসিকতা বা মাদার টেরিজার শান্তিপ্রিয়তা।
কিন্তু আত্মমর্যাদাহীন উপদ্রুত চেতনার বিপক্ষে সোচ্চার অথচ অচঞ্চল মানবীর অদ্বিতীয় দৃষ্টান্ত। একই
নিয়মে মাতঙ্গিনী ও টেরেজা। জীবনের পাশাপাশি শিল্পেও এই অগ্নি সমানে প্রজ্জ্বলিত। দৈনন্দিন
সংঘাতে বিপর্যস্ত প্রাণের সুশীতল স্বান্ত্বনা। তাঁর ব্যঞ্জনে আহার হয়নি ঠিকই, উচ্চ সাধকের ভঙ্গিমায়
জাতিকে উদ্ধুব্ধ করেননি সত্য, তবে তাঁর ছবি মেটায় অন্য এক ক্ষুধা। ঋদ্ধ করে নিভৃত চরারচ।
দর্শনের প্রতিটি ধাপ শিক্ষণীয়। ষড়রিপু তখন শত্রুর ছদ্মবেশে জাগায় না শরীর। সমস্ত অক্ষমতা
অসুস্থতার অন্যতম নিরাময়। বিভাস রায়চৌধুরী একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “কবি বা শিল্পীরা
সমাজের অংশ হিসাবেই তো বড় অংশটার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আছেন, শিল্প তাঁর ব্যক্তিগত অবলম্বন
এবং সামাজিক অস্ত্র।” শিল্পীমাত্রই চিত্রকর নন। যে কোনও ক্ষেত্রে যিনি সর্বোচ্চ স্তরে উন্নীত।
স্বাভাবিকভাবেই তাঁর মৃত্যুদিন (১৭ জানুয়ারী, ২০১৪) সূচিত হয় না তেমন বিশিষ্টতায়। এই ধ্বনি
সে স্বরেই মানায় “আমি মৃত্যুর চেয়ে বড়…।” তিপান্নটি বাংলা, সাতটি হিন্দি ছবি বহন করে এক
অনতিক্রম্য অধ্যায় যেখানে আমাদের মানসম্ভ্রম অনন্তের অঙ্গে অশ্লিষ্ট। অতসী হালদার রীণা ব্রাউন
মল্লিকা ব্যানার্জীরা চলচিত্রের কঠিন বর্ম সরিয়ে প্রেমিকা-কন্যা-সেবিকার পোশাকে সহজেই হাজির
হন চিরচে না আঙিনায়। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মাতার বৃহৎ রূপায়ণে। আর এখানেই তিনি আশার সমগ্রতা,
আত্মার টুকরো অংশের নির্ভরতা। সংস্করণ তথা শুদ্ধির অতুলনীয় সম্ভাবনা। সংতরাং দেবীসুলভ
অপার্থিবতা ধারণ করেও সুচিত্রা সেনের আঙ্গিকে দেবী দুর্গাকে প্রত্যক্ষ করতে, আমার কণ্ঠে অনেকে
কন্ঠ মেলাবেন, আমরাও আগ্রহী।

Facebook
WhatsApp
Email
Scroll to Top