অচিন পাখী

শ্রীনন্দদুলাল মিদ্যা-(শিক্ষক)

রানীচক দেশপ্রাণ উচ্চ বিদ্যালয়

মাথায় কালো ঝুঁটি, লাল ঠোঁট, লাল পা দুটি ঘনকালো দুটি চোখ-হলুদ শরীরে রামধনুর
বর্ণালী। যে দেখলো সেই বলল – ‘আহা কী সুন্দর।’
সত্যিই পাখীটা সুন্দর। শুধু রূপে নয় গুণেও সে মানুষের মতো কথা বলতে পারে, ভালো
মন্দ বিবেচনা করে আগাম সংকেত ও দিতে পারে। এতসব হিসেব করেই রূপ নগরের হাট
থেকে তাকে কিনে এনেছিলেন মহারাজ।
সোনার খাঁচায় রূপোর দাঁড়ে বসে আছে সেই পাখী। খাঁচাখানা ঝুলছিল রাজ দালানে
বসন্ত বাতাসে। এমনি করেই প্রতিটি দিন কাটছিল। হঠাৎ একদিন খাঁচার পাখী লক্ষ্য করল
সামনের পাকুড় গাছের ডালে বসে আছে একটা পাখী। কেমন রোগা রোগা মুখে, তারি দিকে
তাকিয়ে। অনুজ্জ্বল শরীরে উল্লেখযোগ্য কেবল দুটি উজ্জ্বল চোখ। অবাক ভাবটা কাটিয়ে
খাঁচার পাখী জিগ্যেস করল- ‘তুমি কে গো, কোথা থেকে এসেছ? ইত্যাদি, ডালে বসা
পাখীটা বলল—’অনেক দূর থেকে। ঐ আকাশে আকাশে উড়ে বেড়াই। এখুনি ঝড় আসবে
তো তাই এখানে একটুখানি থামা।’ খাঁচার পাখীর কষ্ট হল। খাবারের পাত্র থেকে কয়েকটা
খাবারের টুকরো নিয়ে অচিন পাখীটাকে ডেকে বলল ‘এস খাবার খাও। তুমি বড় ক্লান্ত
অচিন পাখী অবাক। কৃতজ্ঞতার সঙ্গে বলল-‘তুমি সত্যিই সুন্দর।’ খাঁচার পাখী লজ্জায় মুখ
নামিয়ে নিলে। প্রাণের খুশী ভেরে গেল সে। একটু পরেই ভীষণ ঝড় এসে গেল। রাজবাড়ির
লোকেরা খাঁচাকে নিয়ে চলে গেল অন্দরমহলে। সারারাত্রি খাঁচার পাখী দুশ্চিন্তা নিয়ে কাটালো।
ঘুম আনল না। অচিন পাখীর সাথে তার প্রথম পরিচয়ের কথাগুলি কেবলই মনে হতে
থাকল। মহারাজ নিজের কক্ষে খাঁচাটিকে নিয়ে রাখেন, মহারাজ বুঝতে পারলেন কিছু একটা
কারণে খাঁচার পাখী উদ্বিগ্ন। তাই তিনি মাথায় হাত দিয়ে খাঁচার পাখীকে বললেন—ঘুমাও।
খাঁচার পাখীর ঘুম এলো না। কেবলই ভাবল ঝড়ে অচিন পাখীর কিছু হল না তো।
পরের দিন সকালে আবার রাজবাড়ির পরিচারিকা এসে সোনার খাঁচা টিকে দালানে
ঝুলিয়ে দিয়ে গেল। খাঁচার পাখী উদ্বিগ্ন চোখে খুঁজতে খুঁজতে অচিন পাখীকে দেখতে পেল
পাকুড় গাছে, খাঁচার পাখী খুশীতে উজ্জ্বল হয়ে তার কুশল জিজ্ঞাসা করে তাঁর অশান্ত
হৃদয়কে শান্ত করল। এই ভাবেই বেশ কয়েকটি সাল কেটে গেল। সারাদিন অচিন পাখী আকাশে আকাশে ঘুরে বেড়ায়, সন্ধ্যার পূর্বে ফিরে আসে। উভয়ের কথোপকথনে আকাশে বিশালতা খাঁচার সীমাবদ্ধতা নিয়ে কতই না কথা হতে থাকে।
একদিন মন্ত্রীমশায়ের নজরে পড়ে গেল। তিনি খাঁচার পাখীর সাথে অচেনা একটা পার্থীর
সংসর্গ নিয়ে মহা দুঃচিন্তায় পড়লেন। তিনি মহারাজাকে জানালেন। মহারাজ আর কারকে
ডাকলেন। শ্রস্ত্রকার তর্কচূড়ামণি রাজগুরু এই ‘দূষণ’ থেকে খাঁচার পাখীর মুক্তির জন্য
সন্ধ্যায় শাস্ত্র পাঠের ও শ্রবণের দ্বারা মুক্তিউপায় বাতলে দিলেন। এ ছাড়াও পাখীর দুটি পায়ে
অলংকার স্বরূপ দুটি সেকল পরানোরও নির্দেশ দিয়েগেলেন। সেই মতো খাঁচার পাখীর
পায়ে (স্বর্ণ শৃঙ্খল) পরানো হল। সন্ধ্যায় যথারীতি আর পাঠের ব্যবস্থা করা হল। রাজার
শুভানুধ্যায়ী যত নরনারী, যত পুরনারী-পুরুষ শ্রনেকার, পুরোহিত সকলে সেই আরপাঠ
শুনলেন, নিষ্কলঙ্ক হওয়ার মহান ব্যাখ্যায় সকলে উদগ্রীব হয়ে উঠল, মাঝখানে সোনার
খাঁচায় বসে কেবল নীরব হয়ে থাকল খাঁচার পাখী। সকলে বলল—আহা! কী অমৃত কথা।”
পরের দিন খাঁচার পাখীর সাথে অচিন পাখীর দেখা হল। খাঁচার পাখী আর সে দিকে তাকালো
না। সারাদিন ডানার মধ্যে মুখটা খুঁজে থাকল। শুনতে পেল অচিন পাখীর আহ্বান, কিন্তু
সারাদিন কোন উত্তর দিলেনা। বিকালে অচিন পাখী বলে উঠল— ‘ঝড় আসছে। আমি চল্লাম
খাঁচার পাখী, আমার অপরাধ ক্ষমা কোর।” তবু খাঁচার পাখী মুখ তুললে না। একটু পরে ঝড়
এসে গেল। পরিচারিকা এসে খাঁচাটা নিয়ে চলে গেল ভেতরে।
পরের দিন সভা বগল দরবারে। কোতয়াল এসে খবর দিলে – ‘মহারাজ ঝড়ে কারো ক্ষতি
হয়নি তবে একটা বিশ্রী পাখী মরে পড়ে আছে বাঁধের ধারে।’ শুনে মহারাজ গোঁফে চাঁড়া
দিলেন। পুরুতঠাকুর খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে উঠলেন। শুধু বিদুষক—গেয়ে উঠল—“খাঁচার
ভিতর অচীন পাখী কেমনে আসে যায় ।”

Facebook
WhatsApp
Email
Scroll to Top